সোমবার, ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:০৯ অপরাহ্ন
মুহাম্মদুল্লাহ আহনাফ:
সন্তানদের আদব শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে আদর ও শাসন উভয়টিই জরুরি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাসনের তুলনায় ভালোবাসা ও নম্রতা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে সন্তানদের ওপর। পক্ষান্তরে অনেক সময় দেখা যায়, অত্যধিক শাসনসন্তানদের বেপরোয়া করে তোলে। শাসন যেমন সন্তানদের বেপরোয়া করে, ঠিক সামান্য আদরেও তাদের জীবনের গতি পরিবর্তন হয়। সুতরাং শাসনের পাশাপাশি সব সময় তাদের প্রতি নম্রতার দিকটা প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
শিক্ষার্থীদের শাসনের বিষয়টিও ঠিক এমন। অনেক সময় ছাত্রের প্রতি শিথিলতা তার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। তখন তার ভালোর জন্য তাকে শাসন করার প্রয়োজন দেখা দেয়। শাসনের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার কথা হাদিস ও সাহাবাদের আমল দ্বারা প্রমাণিত। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তোমাদের সন্তানরা সাত বছরে উপনীত হবে, তখন তাদের নামাজের আদেশ দেবে। তাদের বয়স যখন দশ বছর হবে, তখন নামাজ না পড়লে তাদের প্রহার করো। আর তখন ছেলেমেয়েদের থেকে বিছানা আলাদা করে দাও।’ সুনানে আবু দাউদ : ৪৯৫
বর্ণিত হাদিসে স্পষ্টভাবে সন্তানকে প্রহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো বর্ণনায় ঘরে লাঠি ঝুলিয়ে রাখার কথাও পাওয়া যায়। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা লাঠি ঝুলিয়ে রাখো, যাতে ঘরের লোকরা তা দেখতে পায়। কেননা তা তাদের তরবিয়তের পাথেয়।’ তাবরারি : ১০৬৭১
আচার-ব্যবহার শেখানোর জন্য যদি শাসন করা না হয়, তবে ছোটরা শিখবে কীভাবে? অনেক সময় দেখা যায়, অভিভাবকরা অভিযোগ করেন, বাচ্চা এখনো ছোট; সে শাসনের কিছু বুঝবে না। সে যা করছে, করুক। বড় হলে তা সংশোধন করা যাবে। এমন মনোভাব কাম্য নয়। হাকিমুল উম্মত হজরত থানভি (রহ.) বলেছেন, ‘বাচ্চাদের স্বভাব-চরিত্র যা গড়ার, পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে গঠন হয়ে যায়। এরপর ভালো-মন্দ যেটাই হয় তা মজবুত ও পাকাপোক্ত হতে থাকে, যা পরে সংশোধন করা কঠিন হয়ে পড়ে। সুতরাং বাচ্চা বুঝুক আর না বুঝুক ছোটবেলা থেকেই তাকে শেখাতে হবে। একসময় সে বুঝবে এবং উত্তম চরিত্র নিয়ে বড় হবে। ইসলাহে খাওয়াতি : ২৫১-২৫২
পিতা-মাতা ও শিক্ষক কর্র্তৃক সন্তান ও ছাত্রদের শাসন সম্পর্কে বলা হয়েছে
১. কোনো শিশু বা ছাত্র তার সহপাঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে, তা শোনামাত্র মেজাজ বিগড়ানো যাবে না। শরিয়তে একপক্ষের অভিযোগের গ্রহণযোগ্যতা নেই। উভয় পক্ষের কথা না শুনে কোনোরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া কিংবা একজনকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। অন্যথায় খোদ ফয়সালাকারীই জালেম সাব্যস্ত হবে। ফাতাওয়া আলমগিরি : ৩/৩০৯
২. সবার কথা শোনার পর যখন ফয়সালা করার ইচ্ছা করবে, মনে কোনোরূপ রাগ স্থান দেওয়া যাবে না। কারণ, রাগের সময় বিবেক-বুদ্ধি লোপ পায়। ফলে অধিকাংশ সময় রাগের মাথায় ফয়সালা ভুল প্রমাণিত হয়। এ কারণে রাগান্বিত অবস্থায় কোনো কিছুর ফয়সালা অথবা শাস্তি দেওয়া শরিয়তে নিষেধ। সহিহ মুসলিম : ১৭১৭
সুতরাং কাউকে শাস্তি দিতে হলে নিম্নের বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে
ক. ঠান্ডা মাথায় বিচার করা। বোখারি : ৭১৫৮
খ. আল্লাহকে হাজির জানা এবং ন্যায়বিচারের নিয়ত করা। সুরা তওবা : ১০৫
গ. হাশরের ময়দানে জবাবদিহির কথা স্মরণে রাখা। সুরা জিলজাল : ৮
ঘ. স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করা। ফাতাওয়া শামি : ৪/৬০-৬১
ঙ. অপরাধীকে সংশোধনের নিয়ত করা। সুরা হুদ : ৮৮
চ. শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে যে শাস্তি সংগত মনে হয়, তা নির্ধারণ করা। সুরা বাকারা : ১৯০
৩. শরিয়তে নাবালেগ বাচ্চাকে বেত বা লাঠি দ্বারা প্রহারের কোনো অবকাশ নেই। প্রয়োজনে হালকা শাসন করা যেতে পারে। একান্ত অপারগতায় হাত দিয়ে প্রহারের অনুমতি আছে, কোনো অবস্থাতেই লাঠি বা বেত দিয়ে নয়। কিন্তু এজন্যও কয়েকটি শর্ত রয়েছে
ক. প্রহার সংখ্যা যেন তিনের অধিক না হয়। ফাতাওয়া শামি : ১/৩৫২
খ. চেহারা ও স্পর্শকাতর অঙ্গ যেমন মাথা, পেটে ইত্যাদিতে আঘাত করা থেকে বিরত থাকা। আদ দুররুল মুখতার : ৪/১৩
গ. জখম হয়ে যায়, দাগ পড়ে যায় এমন জোরে প্রহার না করা। ফাতাওয়া শামি : ৪/৭৯
কারণ, নাবালেগ বাচ্চাকে এই অপরাধে তিনের অধিক প্রহার করা এবং (বালেগ, নাবালেগ সবার ক্ষেত্রেই) মুখম-ল ও স্পর্শকাতর অঙ্গে আঘাত করা হারাম।
৪. কোনো ধরনের অমানবিক শাস্তি দেওয়া যেমন, হাত-পা বেঁধে পেটানো, পিঠমোড়া করে বেঁধে রাখা, সিলিংয়ে ঝোলানো, কপালে পয়সা দিয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে রাখা ইত্যাদি একবারে হারাম ও নাজায়েজ। সহিহ বোখারি : ২৪৪৭
৫. ধামকি বা কড়া কথার মাধ্যমে হোক আর শরিয়ত অনুমোদিত প্রহারের মাধ্যমেই হোক সতর্ক করার উত্তম তরিকা হলো সবার সামনে মজলিশে শাস্তির বিধান করা। যাতে অন্যদের জন্যও তা উপদেশস্বরূপ হয়। সুরা নুর : ২
৬. শাস্তি প্রয়োগের সময় রাগান্বিত অবস্থায় শাস্তি প্রয়োগ করবে না। তবে কৃত্রিম রাগ প্রকাশ করতে পারবে। সহিহ বোখারি : ৭১৫৮
৭. কোনো বাচ্চার দ্বারা অন্য বাচ্চাকে বা এক ছাত্রের দ্বারা অপর ছাত্রকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। এটা শাস্তি প্রদানের ভুল পন্থা। এতে বাচ্চাদের মধ্যে পরস্পরে দুশমনি সৃষ্টি হয়। তুহফাতুল উলামা : ১/৪৯২
৮. শাস্তির পরিমাণ বেশি হয়ে গেছে আশঙ্কা করলে পরে শাস্তিপ্রাপ্তকে ডেকে আদর করবে এবং কিছু হাদিয়া দিয়ে খুশি করে দেবে। তুহফাতুল উলামা : ১/৪৯৭
ভয়েস/আআ